দৃশ্য ১
অন্ধকার মঞ্চে আলো ধীরে
ধীরে ফুটলে দেখা যায় একটি গলি, গলির মুখে (মঞ্চের ডানদিক) জঞ্জাল ফেলার গাড়ি দাঁড়
করানো, একটু দূরে পাড়ার রক। রকে উপবিষ্ট তিনজন যুবক আড্ডায় মশগুল। আড্ডার বিষয়
হচ্ছে কঙ্কাল-কাণ্ড। পার্ভার্ট না পাগল, খুন না
তন্ত্রসাধনা, সম্পত্তি হাতানো নাকি অত্যধিক দিদিপ্রীতি, ফাঁসি হওয়াই বিধেয় না
ইলেকট্রিক শক্ দিলে ভাল হয় এসব গম্ভীর আলোচনা যখন তুঙ্গে উঠে তার্কিকদের
স্বরসপ্তগ্রাম তারসপ্তক ঘুরে সাত রাউণ্ড চা আর দু-প্যাকেট সিগারেট শেষ করে ফেলেছে,
এমন সময়ে মঞ্চে হেমচন্দ্রের প্রবেশ। তাকে দেখে বয়েস ঠাহর করা শক্ত—পঁচিশ হ’তে
পারে, আবার পঁয়ত্রিশও হ’তে পারে। গায়ে গাঢ় রঙের জ্যাকেট চাপানো, হাতে ছড়ি, কব্জিতে
হাতঘড়ি, পায়ে বুটজুতো, মাথায় ডার্বি টুপি। অনেকটা শার্লক হোম্সের মতো সাজ। দেখলে
মনে হয় অনেকদিন পথে পথে ঘুরেছে এই এক পোশাকে। প্রবেশ করে সে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক
দেখে, যেন কিছু একটা খুঁজছে। এর পরপরই সে রকের যুবাদের দিকে এগিয়ে যায়। যুবকেরা তাকে এগিয়ে আসতে
দেখে আলোচনা থামায়। তিনজনই কৌতুহল ভ’রে হেমকে মাপে।
হেম। (গলা খাঁকরে) শুনুন,
বলছিলাম, এই রাস্তাটা – মানে, এটা কোন জায়গা?
যুবক ১। আপনি কোথায় যাবেন?
হেম। এখানে কেএফসি-টা আছে
না?
যুবক ২। (চোখ কুঁচকে) আপনি
এ-পাড়ায় এসেছেন কেএফসি খুঁজতে?
যুবক ৩ ও ১।
হ্যাহ্যাহ্যা!হ্যাহ্যাহ্যাহ্যাহহ্যা!
হেম। হ্যাঁ মানে -- ওইদিকের
গলি দিয়ে ঢুকলে শেষমাথায় একটা কেএফসি পাবো না?
যুবক ২। (হঠাৎ বুঝতে পারে;
কোঁচকানো চোখ আর কপাল আলগা হয়) ওহ্, কালুয়ার ফিশ চপ! তার জন্য এত স্টাইলিশ ইংরেজি
নাম দিলে চলে, দাদা? ... হ্যাঁ, আছে। কিন্তু সে তো সাড়ে পাঁচটার আগে খুলবে না।
হেম। হুম্ম্ ... (গোমড়া মুখ
ক’রে অল্পক্ষণ ভাবে) সিগারেট হবে?
(যুবক ১ ও ২ তাড়াতাড়ি
দেশলাই পকেটে লুকোয়)
যুবক ২। বিড়ি চলবে?
হেম। চলবে। না -- মানে চলত, এখন আর চলে
না।
যুবক ১। (কানে কানে যুবক
৩-কে) ঢিলে আছে।
(একথা শুনে ৩ ফিক্ ক’রে
হাসে।)
যু ২। দাদার আসা হচ্ছে কোত্থেকে?
এদিকে তো দেখিনি এর আগে।
হেম। কোপেনহাগেন –
ডেনমার্ক। বিড়িটাই দিন দেখি।
যু ২। অ...(প্যাকেট এগিয়ে
দিতে থমকায়। মুখে থতমত ভাব নিয়ে তাকায়, আরেকবার ভালো ক’রে হেমের মুখখানা জরিপ
করবার চেষ্টা করে) কী বল্লেন? কোন দেশে হাগেন...ডেনমার্কে?
হেম।(বিড়ি নিয়ে প্যাকেট ফেরত
দিতে দিতে) ডেনমার্ক। ডেনমার্ক থেকে আসছি।
যু ৩। ডেনমার্ক? ড্যানিশ ফুটবল?
(গলা নামিয়ে যুবক ১ কে) বলে কি রে? অ্যাঁ? ড্যানিশ ডিনামাইট!
যু ১। ফুল মেন্টাল কেস। (দুজনের
অট্টহাসি)
যু ২। (অতিকষ্টে হাসি চাপার
চেষ্টায় মুখ বিকৃত ক’রে) দাদা, আপনার কোনো আইডি কার্ড আছে, মানে এই ধরুন পাসপোর্ট,
কি ভোটার আইডি? আপনার দেশে ভোট হয়?
হেম। (হতাশ গলায়) হ্যাহ্,
আমাদের দেশেই হবে এখন। রাজপাট যেতে বসেছে।
যু ২। রাজার জন্য আপনার
ভারি দুঃখ মনে হচ্ছে?...তা কই, আইডি-টা তো দেখালেন না?
যু ৩। এই হ্যাঁ, কই,
ড্যানিশ ডিনামাইটের ভোটার কার্ড কীর’ম হয় দেখবো!
হেম। আমায় ভোট দিতে হয় না।
যু ১। ওরেব্বাস!
যু ২। কেন? ওখানেও বুঝি
আমাদের মতো রিগিং হয়? দাদাদিদিরা প্রক্সি দিয়ে দেয়?
হেম। আমি হ্যামলেট...প্রিন্স
অফ ডেনমার্ক। আমায় ভোট দিতে হয় না। আমাদের ওখানে রাজার
রাজত্ব, মানে আমার বাপের রাজত্ব।
যু ১। সং।
যু ৩। পালা থেকে পালিয়ে
এসছে।
যু ১। সার্কাসের পাগলা
শিম্পাঞ্জি। (গলা চড়িয়ে) কোন মেন্টাল হাসপাতাল থেকে পালালেন দাদা?
হেম। (২ নম্বর যুবককে)
কেএফসি...সাড়ে পাঁচটা বেজেছে?
যু ২। আপনার কাছে আইডি
থাকলে দেখান। নাহলে ওই যে বড় রাস্তার মোড়ে ট্র্যাফিক পুলিশ দেখছেন, ওর কাছে নিয়ে
যাবো!
হেম। স্যরি স্যার, আমায়
যেতে হচ্ছে। বিড়ির জন্যে ধন্যবাদ!
(২ নং যুবক প্রায় লাফিয়ে
উঠে হেমের কব্জি দু’হাতে পাকড়াও করে, বাকি দুজন যুবকও দেখাদেখি মহা উৎসাহে যোগ
দেয়)
যু ২। সেটি হচ্ছে না, চাঁদ,
এখন তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে। শালা, সেয়ানা হয়েছ খুব, না? আবার পাগলা সাজা হয়েছে!
দে শালাকে!
(তিনজনে মিলে হেমকে পিটতে
থাকে)
যু ১। মার শালাকে!
যু ৩। মার শালাকে!
(মিনিট তিনেক আড়ং ধোলাই
চলার পর দেখা যায় হেম গলির রাস্তায় হাত-পা ছড়িয়ে ফ্ল্যাট, যুবক তিনজন তার তিনদিকে
ঘিরে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে।)
যু ১। অনেকদিন বাদে একটা
মালকে এর’ম উদোম ক্যালানো গ্যালো। ওহ্, যা ফিল হচ্ছে না
মাইরি!
যু ৩। ইয়াহ্-হু! কালকে
থেকে আবার জিমে যাবো!
যু ২। আবে নে নে, এবার
মালটাকে সাইড কর। রাস্তা থেকে লোকজন এসে পড়লে ফালতু ক্যাচাল বাধবে।
যু ১। রিল্যাক্স! হোয়াই সো
সিরিয়াস, ম্যান?
যু ৩। ইয়াহ্ বস্, জাস্ট
চিল!
যু ২। (খেঁকিয়ে উঠে) অনেক
অ্যামেরিকা মারিয়েছিস ক্যালানে, এবারে হাত লাগা!
(বিরক্ত হয়ে ২ নং যুবক
হেমের মুখে একটা লাথি কষায়। সঙ্গে সঙ্গে বাকি দুজন হেমের দুটো হাত আর ২ নং নিজে
তার পা দুটো ধরে তাকে চ্যাংদোলা করে জঞ্জালের গাড়ি অব্দি নিয়ে আসে। তারপর তার
অচেতন দেহটাকে চাগিয়ে তুলে গাড়ির ভেতর ফ্যালে। তিনজনে হাতে হাত ঝাড়ে। ২ নং বিশ্রী
মুখ ক’রে সশব্দে থুতু ফ্যালে। তারপর তিনজন রাস্তার দিকে যেতে উদ্যত হ’লে মঞ্চের আলো কমতে
কমতে নিভে যায়।)
দৃশ্য ২
মঞ্চে ধীরে ধীরে আলো জ্বলে
ওঠে। গলির ভেতরে ভোরবেলার দৃশ্য। শহরে বন্যা হ’লে যেমন বড় রাস্তার জল নেমে যাওয়ার
কিছুদিন পরও গলিঘুঁজিতে জল জমে থাকে, তেমনি এই রাত ফুরোবার সময় অন্ধকার যেন গলিটার
ভেতর একটু বেশিক্ষণ ধরেই জমে আছে। ব্যস্তসমস্তভাবে ময়লা ইউনিফর্ম পরা একজনের
প্রবেশ। সে পুরসভার কর্মী, জঞ্জালের গাড়ি নিয়ে যেতে এসেছে। গাড়ির কাছে এসে হাতল
ধরে টান দিয়ে থমকায়। হাতল ছাড়ে, দু-পা মঞ্চের সামনের দিকে এগিয়ে এসে পা ফাঁক করে
হাতদুটো দুপাশে টানটান ক’রে মেলে দাঁড়ায়। ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করে কিছুক্ষণ।
তারপর শিস্ দিতে দিতে আবার জঞ্জালের গাড়ির হাতল ধ’রে টানতে শুরু করে। এবারো থমকায়,
শিস দেওয়াও আপনি থেমে যায়। বিরক্ত মুখ ক’রে গাড়ির ভেতর জঞ্জাল-রাখা জায়গাটার দিকে তাকায়।
সাফাইওলা। (হাতল ছাড়ে, চ্যাঁচায়, লাফায়) ঈইইইইইইইইইক!!!!!
লাশ আছে!!
(জঞ্জাল-গাড়ির হাতল হঠাৎ
ছেড়ে দেওয়াতে ধপ্ করে গাড়িটা সামনের দিকে মুখ থুবড়ে পড়ে। সেইসঙ্গে জঞ্জালসমেত হেম
সামনের দিকে গড়িয়ে আসে, এবং জেগে উঠে ধড়মড় করে জঞ্জালের ওপরেই উঠে বসে।)
হেম। (ধরা ধরা ক্ষীণ গলায়,
চোখ বুজে) আহ্! ওওওহ্ মা গোহ্! (দুহাতে মাথা ধ’রে কাতরাতে থাকে)
সাফাই। হেই! মরে নাই। হেই তুমি ক্যা? মাল
খায়ে পইড়ে থাকনের আর জাগা পাও নাই পলাপাইন? ভাগো হিঁয়াসে! নাইলে পুলিশ ডাকেগা।
হেম। (চোখ তখনো বোজা) আহ্,
ওহ্, ডাক্...ডাক্তার ডাক্।
সাফাই। (অবাক হয়, তারপর
হেমকে কয়েক সেকেন্ড দেখে নিয়ে) অ্যাঁহ্হ্, আমায় ব্যায়রা পাইছ, শালা? চুল্লু খায়ে
যত রাজ্যের মাতাল নালায় পইড়ে থাকবা, আর আমি তমাদের সেবা লাগি হেই ভরব্যালা ডাক্তার-বদ্যি
আইন্তে ছুটি! আরে মাতাল, আরে ও পাগলা, আমি সইরকারি চাকরি করি, বুঝ্লা? ইরি! মাদার
টেরিজা পাইছে!
(হেম একচোখ দিয়ে সাফাইওলাকে
দ্যাখে, তারপর একহাতে মাথা টিপতে টিপতে আরেকটা হাত সাবধানে জ্যাকেটের ভেতরে ঢোকায়।
দেখতে দেখতে হাত বের করে এনে সাফাইওলার মুখের সামনে মেলে ধরে। তালুর উপর দুটো
সোনালি কয়েন রাখা।)
সাফাই। (হেমকে হাত বাড়াতে
দেখে প্রথমে একলাফে বেশ খানিকটা পিছিয়ে যায়, তারপরেই কয়েন দুটো চোখে পড়াতে
নাকেমুখে হাত চেপে একটু একটু ক’রে এগিয়ে আসে) এহ্-ইটা কি?
হেম। রাজার শীলমোহর।
ডাক্তার ডাক্! জলদি।
সাফাই। কোন্ রাজা? এই তুমি
এগুলান চুরি কোরছো? আর কটা লুকায় রাখছো জামার ভিতর?
হেম। এগুলো সোনার। এখন রাখ,
ডাক্তার ডেকে দিলে আরো দুটো পাবি।
সাফাই। সোনাই তো লাগে!
(কিছুক্ষণ চক্চকে চোখে কিছু একটা ভাবে, তারপরে খুব ব্যস্ত হয়ে) এই গলির শ্যাষে
পলাডাক্তারের বাড়ি আছে। তমারে আমি সেইখানে নিয়া যাইতাছি। তুমি গাড়ির ভিতরে যেমন
বইসে আছো থাকো। আমি ঠ্যালা দিয়া নিয়া যাইতাছি। পরে যে দুটা মোহর দিবা কইছ,
স্যাইগুলান না দিলে আমি ডাক্তারেরে কমু যে তুমি চোর আছ! আমায় মোহর দিছ হেই কথাও কাউরে
বলবা না!
হেম। ঠিক আছে। চল্। ওহ্ মা...আহ্!(একহাতে
মাথা টিপতে থাকে)
সাফাই। (এদিক-ওদিক ওপরনীচ
সবদিক দেখে নিয়ে গাড়ির হাতল ধরে টানা-রিকশার মতো ছুটতে শুরু করে, মঞ্চের বাঁদিক
দিয়ে বেরিয়ে আবার ডানদিক দিয়ে ঢুকে একটা দরজার সামনে এনে গাড়িটা দাঁড় করায়। আবার
চারদিক সাবধানে দেখে নিয়ে ফিসফিস ক’রে হেমকে) মোহরগুলা দাও এবারে।
(হেম দরজার গায়ে তাকায়।
সেখানে নেমপ্লেট ঝুলছে, তার গায়ে লেখা “Dr. Palash Sorcar, MBBS Cal.” পকেটে হাত দিয়ে
আরো দুটো সোনালি কয়েন বের ক’রে সাফাইওলার পেতে রাখা
হাতে সেগুলো দেয়। ব্যগ্রভাবে সেদুটো নিয়েই জামায় বারকয়েক ঘষে সাফাইওলা নিজের পকেটে
পুরে নেয়। হাতের ইশারায় হেমকে নামতে বলে। হেম বেশ কষ্ট করে নেমে
আসে।)
সাফাই। ডাক্তার কি অন্য
কারে কিছু বলবা না! ডাক্তার তমারে পুলিশে দিলে পুলিশকেও কিন্তু আমার কথা কিচ্ছু
বলবা না। আসলাম। (গাড়ি নিয়ে আবার উল্টোবাগে দৌড় দেয়।)
(হেম
খোঁড়াতে খোঁড়াতে সিঁড়ির দুধাপ বেয়ে দরজার কড়া নাড়ে। একবার, দুবার। দরজা খুলে যায়।
একজন চাকরকে দেখা যায়, গেঞ্জি-লুঙ্গি পরা, কাঁধে গামছা।)
চাকর। কী চাই?
হেম। ডাক্তার...।
চাকর। এই সাতসক্কালে বাবু
কারুর সাথে দ্যাখা করেন না। আপনি পরে আইসেন, সাড়ে দশটার পর।
হেম। (একটু গলা তুলে,
কিন্তু কাতরভাবে) ডাক্তার! ডাক্তারবাবু! ডাক্তারবাবু!!
চাকর। আরে হাঁক পাড়েন
ক্যান? বল্লাম তো দ্যাখা হইব না অহন। যতোসব!
(ভেতর থেকে পলাডাক্তারের
গম্ভীর গলা শোনা যায়)
ডাক্তার। কে রে ওটা নাসির?
কী চায়?
চাকর। দেইখ্যা তো মাতাল
পাগল-ছাগল লাগতাসে। বল্লাম অহন দ্যাখা হইব না, তা এ তো নাছোড়বান্দা হইয়া পেছনে
লাগছে কত্তা!
ডাক্তার। (ভেতর থেকেই) নিয়ে
আয় দেখি। দাঁড়া, আগে ভালো ক’রে দ্যাখ ছুরি-টুরি লুকিয়ে রেখেছে কিনা।
চাকর। হ কত্তা। ...(হেমের
গায়ে হাত বুলিয়ে তল্লাশি নেয়।) ভালাই নোংরা! না কত্তা, ছুরি-কাঁচি কিছু নাই।
ডাক্তার। আন।
(মঞ্চ সঙ্গে সঙ্গে একেবারে
অন্ধকার হয়)
দৃশ্য ৩
(মঞ্চে আলো জ্বললে দেখা যায়
একটা সাজানো পুরনো ঢঙের বৈঠকখানা। আসবাবপত্র দামি দেখতে। লম্বা লম্বা আলমারিতে
প্রচুর বই, তারমধ্যে অনেকগুলোই চামড়ায় বাঁধানো, সোনার জলে নাম লেখা। একটা বড়
আরামকেদারায় বছর পঞ্চাশের ফরসা পেটমোটা পলাডাক্তার বসে বসে কাগজ পড়ছিলেন, চাকর
হেমকে নিয়ে ঢুকলে চশমার উপর দিয়ে চোখ তুলে তাকালেন। খোঁড়াতে খোঁড়াতে হেমের প্রবেশ।
তাকে দেখেই ডাক্তার একইসঙ্গে অবাক আর বিরক্ত। হেমের বিচিত্র সাজ দেখে তিনি অবাক;
আর বিরক্তির কারণ হেমের নোংরা জামাকাপড় থেকে বেরনো দুর্গন্ধ।)
হেম। বাঁ পায়ে বোধহয়
ফ্র্যাকচার হয়েছে, ডাক্তার! আর পারছি না দাঁড়াতে।
ডা। দাঁড়াতে হবে না আর,
বসুন। (হেম সোফার দিকে এগোয়)উঁহু, মেঝেয়।
হেম। মেঝেয়?
ডা। মেঝেয়।
হেম। পায়ে অসম্ভব ব্যাথা
করছে!
ডা। হুম্। তাহলে নাসির একে
একটা চেয়ার এনে দে চেম্বার থেকে।
চাকর। আজ্ঞা, কত্তা।
(চাকরের প্রস্থান, ডাক্তার
ভালো ক’রে চোখ বুলিয়ে নেন হেমের উপর। পাশের টেবিল থেকে একটা পাইপ নিয়ে তাতে তামাক
ভরতে শুরু করেন। ততক্ষণে চাকর চেয়ার
নিয়ে প্রায় নিঃশব্দে ঘরে ফিরে আসে এবং হেমের পাশে চেয়ারটা রেখে বেরিয়ে যায়। হেম
সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারে বসে পড়ে। ডাক্তার পাইপ ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে চিবিয়ে চিবিয়ে হেমকে উদ্দেশ্য
ক’রে আলাপ শুরু করেন।)
ডা। ক’ বোতল?
হেম। (পায়ে হাত বুলোতে
বুলোতে) স্যরি?
ডা। দিশি না বিলিতি?
হেম। (বিরক্ত) কোনোটাই না।
কাল সন্ধ্যে নাগাদ আপনার পাড়ার কয়েকটা বখাটে বেকার ছেলের হাতে বেদম পিটুনি খেতে হল
খামোখা। অপরাধ, তাদের প্রশ্নের জবাবে সত্যি কথা বলেছি। এদেশে এসে ইস্তক দেখছি,
সত্যি কথা কেউ নিতেই পারেনা। আজব!
ডা। কোন্ সত্যি কথাটা ওদের
বলেছিলেন একটু শুনি।
হেম। এই যে আমি হ্যামলেট,
প্রিন্স অফ ডেনমার্ক। শুধু জানতে চেয়েছিলুম কটা বাজে। এই পাড়ায় শুনেছি কেএফসির
চপের...
ডা। দাঁড়ান দাঁড়ান! কী
বল্লেন, আপনি হ্যামলেট? মানে শেক্সপীয়রের হ্যাম...?
হেম। আপনি দয়া ক’রে আমার
পা-টা দেখুন। মনে হচ্ছে কেউ একশোটা ধারালো দাঁত দিয়ে এখানকার (কাফ মাসলে হাত দিয়ে
দেখায়) মাংসটা ভেতর থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। এখুনি কিছু একটা করুন। আমি আপনার ফী
মোহর দিয়ে মেটাতে পারব।
ডা। মোহর?
হেম। আজ্ঞে হ্যাঁ।
ডা। কই দেখি!
(হেম জামার ভেতর হাতড়ে
কয়েকটা সোনালি কয়েন বের করে ডাক্তারের বাড়ানো হাতের তালুর উপর রাখে। এসবের মধ্যে
ব্যথায় তার মুখ বারবার বিকৃত হয়, এদিকে কয়েন নেড়েচেড়ে দেখে ডাক্তারের মুখ হাঁ)
গুড হেভেন্স! এতো
কোপেনহাগেনের ক্রোন! এ কোথায় পেলেন?
হেম। আবার সেই এক কথা!
কোথায় পেলেন! আরে আমি কোপেনহাগেন থেকে আসছি। কোথায় আবার পাবো? আপনি পা-টা দেখবেন
প্লিজ?
ডা। আপনি দিনেমার?
হেম। মার? মার অনেক খেয়েছি
মশাই, আপনাদের এই গুন্ডাভরতি পাড়ায়। সেকথা আর নাই মনে করালেন!
ডা। আহা, দাঁড়ান দেখি আপনার
পা-টা।
(ডাক্তার হেমের কাছে এসে
কিছুক্ষণ পরীক্ষা করেন, পায়ে হাত দিতেই হেমের আহা-উহু বেড়ে যায়। খানিকক্ষণ এরকম
চলার পর ডাক্তার পাশের ঘর থেকে তাঁর বাক্স নিয়ে আসেন, আরও কিছুক্ষণ চলে চিকিৎসা।
শেষমেশ ডাক্তার উঠে দাঁড়ান।)
হেম। কি বুঝলেন? ভাঙলো
নাকি?
ডা। তা ভাঙলে আশ্চর্য হবো
না। এক্স রে করাতে হবে একটা। ল্যাব খুলতে খুলতে দশটা, আর এখন হল গিয়ে সাড়ে সাত।
আপাতত যা ক’রে দিয়েছি তাতে এই ক’ঘন্টা ব্যথা সহ্য হয়ে যাবে।
হেম। হুম্, ব্যথাটা কম
লাগছে বটে।
ডা। লাগবারই কথা। এখন বলুন
তো দেখি মশাই, আপনার বৃত্তান্তটা কি, শুনি। আপনি দিনেমার, আর এমন বাংলা বলছেন ঝর্ঝর্
করে, তায় গায়ের রঙটাও তো তেমন খোলতাই নয় যে একবাক্যে ইউরোপিয়ান বলে মেনে নেবো! আর
এসব হ্যামলেট-ট্যামলেটই বা কী বলছেন? আপনি কি সেই যাকে বলে, একেবারে বইয়ের পাতা
থেকে উঠে এলেন নাকি, হ্যাহ্যা? (চশমা ঠিক করতে করতে আসন গ্রহণ)
হেম। হ্যাঁ। আমি হ্যামলেট।
ডেনমার্কের রাজসিংহাসনের দ্বিতীয় দাবিদার। অবিশ্যি, বাবা আমাকেই বেশি ফেভার করেন...
ডা। ধীরে বৎস, ধীরে। আমি
যতদূর পড়েছি, তাতে হ্যামলেটের গল্প শেক্সপীয়রসাহেব ধার করেছিলেন কোন্ এক প্রায়
মধ্যযুগীয় কিংবদন্তি থেকে। তা আপনি আসছেন কোন সময় থেকে? শেক্সপীয়র, নাকি সেই
কিংবদন্তির কাল থেকে? আমি ধরে নিচ্ছি আপনাকে টাইম ট্র্যাভেল করেই এতদূর আসতে হয়েছে
নিশ্চয়ই।
হেম। (চোখেমুখে বিস্ময়) টাইম
ট্র্যাভেল করবো কী ক’রে? (কাঁধ ঝাঁকিয়ে, হাত নেড়ে) না না, টাইম-স্পেস কোনোটাই আমায়
ট্র্যাভেল করতে হয়নি। আমার ভাগ্য ভালো বলতে হবে, উইটেনবের্গ-এ পড়ার সময় সেখানকার
এক লোকাল উৎসবে ম্যাজিক শো দেখতে ঢুকেছিলুম। সেখানে তাঁবুর ভেতরে নানান খেলা
দেখানো চলছে। আলো-আঁধারি মিলিয়ে সে এক বিচিত্র পরিবেশ। আমার বেশ মজাই হচ্ছিলো!
(থেমে হঠাৎ এদিক ওদিক দেখতে থাকে)
ডা। কী হ’ল?
হেম। জল খাবো।
ডা। আহ্, ভুলেই গেছিলাম,
ছি ছি কী লজ্জার কথা। এখুনি বলছি; নাসির! নাসিরুদ্দিন! (চাকরের প্রবেশ)
চাকর। আজ্ঞা বলেন কত্তা।
ডা। এই নে, (পকেট থেকে
পার্স বের করে কয়েকটা নোট গুনতে গুনতে) শর্মার দোকান থেকে কচুরি, জিলিপি আর যা যা
হয়েছে দুজনের মতো নিয়ে আয়। এসে চা বানিয়ে দিবি দুটো।
চাকর। দুটা, কত্তা? (আড়চোখে
হেমের দিকে তাকায়)
ডা। (ধমকে ওঠে) কানে কম তো
শোনো না, বাপু! যা বলছি, কর্গে যা! ছুট্টে যাবি আসবি। চা-টা জলদি চাই!
(চাকরের প্রস্থান)
হ্যাঁ, তারপর কি বলছিলেন? আলো-আঁধারির
মধ্যে কি দেখলেন?
হেম। দেখলুম, একপাশের একটা
ছোটো ঘরের পর্দা ঠেলে এক জিপ্সি বুড়ি আমায় তার কুতকুতে হলদে চোখ চেয়ে দেখছে। দেখে,
আমার কেমন যেন করে উঠলো, জানেন!
ডা। আচ্ছা?
হেম। (উদাস চোখে, যেন
বহুদিনকার পুরনো কথা মনে করতে হচ্ছে) হ্যাঁ, কেমন একটা...মনে হল, আমার ওই বুড়ির
ঘরের ভেতরটা একবার ঢুকে দেখা দরকার। একটা ঝিমুনি, একটা অদ্ভুত গন্ধ...খারাপ কি
ভালো ঠাওর করতে পারলুম না...নাকি, তেমন কিছুই হয়তো নয়, হয়তো বা আমারি মনের ভুল, কি
থেকে জানি না এমনটা মনে হতে লাগলো—সেই তখন থেকেই এমনটা হ’তে লাগলো, যে মুহূর্ত
থেকে আমার চোখ ওই জিপসির চোখে লেগেছে।
ডা। আপনি তার ঘরে ঢুকলেন?
হেম। হ্যাঁ, ঢুকলাম। এখন
ভাবলে বেশ বুঝতে পারি যে, ঢুকতে বাধ্য হয়েছিলুম।
ডা। তারপর?
হেম। তারপর স্পষ্ট দেখলুম,
বুড়ি আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমার পা আপনা থেকেই তার দিকে হাঁটা লাগালো। একটা
প্রায় কালচে হয়ে যাওয়া লাল ভেলভেটের ভারি পর্দা ঠেলে আমি তার ঘরে ঢুকলুম। সেখানে
বুড়িটা আমায় একটা ছোটো, নিচু গোল টেবিলের সামনে বসালে, নিজেও সে বসলে উল্টো
দিকটায়। টেবিলের উপরে রাখা ছিলো একটা কাঁচের বল—একটা ফুটবলের সাইজের হবে। আমার চোখ
থেকে চোখ না সরিয়েই সেই জিপসি তার রোগা রোগা হাতগুলো আমার প্রায় মুখের কাছে এনে
নানান মুদ্রা ক’রে ঘোরাতে থাকলো। আর সেইসঙ্গে তার হাতের অজস্র ধাতব গয়নারা একসঙ্গে
বেজে উঠল। সে আওয়াজ শুনে আমি কির’ম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলুম!
ডা। কিমাশ্চর্যম্! তোমার
মতো একটা পড়াশোনা জানা ছেলে, এই ভুজুং-ভাজুং-এ কাত হয়ে গ্যালো! – এই স্যরি, আমি
আপনাকে ‘তুমি’ ব’লে ফেল্লাম।
হেম। না না, বলুন না, আপনি
আমার চেয়ে বয়েসে অনেক বড়, স্বচ্ছন্দে তুমি বলতে পারেন।
ডা। (স্বগত) বটে! তুমি হ’লে
কিনা সপ্তদশ শতাব্দীর চরিত্র, আমি টোয়েন্টি-ফিফ্টিন—আর বয়েসে আমি হলাম গিয়ে বড়! হাহ্!(গলা
খাঁখারি দিয়ে আবার হেমকে উদ্দেশ্য ক’রে) আচ্ছা বেশ, বয়েসের প্রসঙ্গ নাহয় এখন থাক,
তুমি বরং সেই তাঁবুর ভিতরে আর কী ঘটল সব বিস্তার ক’রে বলো!
(দুহাতে দুটো বড় চাঙারি
নিয়ে চাকরের প্রবেশ।)
এই যে নাসির, শিগ্গির
জলখাবার লাগাও! গপ্পো জমে উঠেছে!
হেম। (ডাক্তারের দিকে না
তাকিয়ে একইরকম উদাস ভাবে) সেইসব গয়নার মিষ্টি টুংটাং শুনতে শুনতে আমি আরো একটা
আওয়াজ শুনতে পেলুম। জিপসি আমায় কিছু একটা শুধাচ্ছে। একবার নয়, বেশ কয়েকবার সে একি
কথার পুনরাবৃত্তি করলে। আমি প্রথমটা তার গয়নার আওয়াজে অন্যমনস্ক হয়ে ছিলুম বলে বুঝতে
পারিনি, কিন্তু তারপর বুঝলুম সে আমায় জিজ্ঞেস করছে—ভারি মিষ্টি গলায়—যেন কোনো
বাচ্চা মেয়ের গলাঃ “হ্যামলেট, হ্যামলেট, যে বসবে সিংহাসনে, তার মনের সত্যিকারের
বাসনা কি? কি হতে ইচ্ছে করে হ্যামলেটের? কি চায় সে? কার মুখ ভেসে ওঠে হ্যামলেটের
স্বপ্নে?”
(এইসময় চাকর ঢুকে দুজনকার
টেবিলে চা জলখাবার সাজিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যায়, দুজনের কেউ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না।
হেম ব’লে চলে)
আমি তার প্রশ্নগুলো শুনতে
শুনতে অনেকদিনের পুরনো সব স্মৃতিতে যেন হারিয়ে গেলুম। আমার ছোটবেলার সব ঘটনা
একেবারে ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে যেতে লাগলো!
ডা। সিনেমার মতো?
হেম। (ঘাবড়ে) কী বল্লেন?
ডা। ও কিছু না। তুমি বলে
যাও।
হেম। ছেলেবেলার সব কথা ছবির
মতো মনে পড়ে যাচ্ছিলো! শুধু একবারের জন্য মনে হ’ল, আমি এ কোথায় এসে পড়েছি? করছিটা
কি এই ঘুপচি তাঁবুর ঘরে বসে? কিন্তু সেই মিষ্টি সুরেলা গলা আমায় যেন সব সন্দেহের
পারে ঠেলে নিয়ে গ্যালো। আমি ওই ঘোরের মধ্যেই বলতে লাগলুম, “মা! মায়ের মুখ দেখছি...মা
আমায় নিয়ে রাজপ্রাসাদের বাগানে ঘুরতে বেরিয়েছে...আমার হাত ধ’রে, আমি মা’র কোলে উঠব
ব’লে বায়না করছি; আর—আরেকটা মুখ—ওহ্-ও-ওফেলিয়া!”
ডা। অ্যাই! এতক্ষণে ঠিক পথে
এসছে। জানতাম শেক্সপীয়র পড়ে মাথাটা গ্যাছে। বাবা, অ্যাতো ভাবুক, অ্যাতো
ইম্যাজিনেটিভ হ’লে আজকের দিনে চলে? ওই দ্যাখো, আমার আলমারিতেও দু-ভল্যুমে কমপ্লিট
ওয়ার্ক্স অফ শেক্সপীয়র রাখা আছে। সেই ইন্টারমিডিয়েট থেকে পড়ছি। নাটক, সনেট কিছুই
বাদ রাখিনি! তুমি যে নাটকটির চরিত্রগুলোর সঙ্গে নিজেকে গুলিয়ে ফেলেছ—না চিন্তার
খুব একটা কারণ নেই—(বেশ প্রসন্নগর্বিত মুখে)একে সাইকায়াট্রির ভাষায় ক্লাস্টার ‘এ’
স্কিজোটাইপাল পারসন্যালিটি ডিসঅর্ডার বলা হয়ে থাকে; কয়েকটা সিটিং-এ থেরাপি নিলেই
অনেকটা উপকার হয়। আমার একজন চেনা খুব নামকরা প্র্যাক্টিশনার আছেন, এই সাউথেই
চেম্বার, তাঁর কাছে তোমায় রেফার করে দিচ্ছি, এই নাও ফোন নাম্বার। (নিজের কললিস্ট
ঘেঁটে একটা নম্বর বের করে প্যাডে খস্খস্ করে লিখতে লিখতে) তোমার এখন বয়েস কত
হবে...পঁচিশ কি ছাব্বিশ বড়জোর...তুমি এখন যাকে বলে লাইফের একেবারে প্রাইমে—এখন এসব
খেয়ালে মেতে থাকলে চলে কি করে বলো দেখি বাবা? বাড়ির লোকজনের কথাটাও তো একটু ভাবতে
হয়! এখন কাজেকর্মে মন দাও, সেট্ল্ করো। (প্যাডের থেকে চোখ তুলে) এই তুমি নিশ্চয়ই
ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র তাই না? যাদবপুর না প্রেসিডেন্সি? কি হ’ল?
(ডাক্তারের উল্লিখিত ভাষণ
চলাকালীন হেম ফ্যালফ্যাল করে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন কিছুই শুনতে পায়নি)
হেম। আমার এই জবাবে বুড়ির
গলার জোর যেন বেড়ে গ্যালো। সে তার মধুমাখা স্বরে ইনিয়ে বিনিয়ে আরো অনেক কথা
জিজ্ঞেস করতে লাগলো আমায়। জিজ্ঞেস করতে লাগলো, “আহ্! মা-কে দেখতে পাচ্ছে
হ্যামলেট! মা-র কথা, ওফেলিয়ার কথা মনে পড়ছে? মা-র কথা ভাবলে, ওফেলিয়ার কথা মনে এলে
দুর্বল লাগে না, হ্যামলেট? রাজপুত্রের শক্ত চোয়াল শিথিল হয়ে যায়, তাই না হ্যামলেট?
হ্যামলেট দুর্বল! নিজের হকের জিনিস যে ছিনিয়ে নেয়, আর যে ছিনিয়ে নিতে তাকে সাহায্য
করে, তাদের গলা হ্যামলেট তরোয়াল দিয়ে কাটতে পারে না! তরোয়াল হ্যামলেটের কোমরবন্ধে
কেবলই গয়নার মতো ঝুলতে থাকে! হিহিহি!! দুর্বল, খু-উ-ব দুর্বল!” এইসব শুনে,
আলো-অন্ধকার মেশানো ঘরের লতাপাতার গন্ধে আমার মাথায় নেশা চড়ে গ্যালো। রক্তের নেশা!
নিজেকে আমার যে খুব দুর্বল, খুব ভীতু বলে মনে মনে গোপন ভয়টা পুষে রেখেছি, সেকথা এই
জিপসি বুড়ি জানলে কি’করে? যে কথা কাউকে বলিনি, আমার অ্যাতো কাছের দু-তিনজন
মানুষকেও যে ভয় বুকের সিন্দুক খুলে কোনোদিন কোনো দুঃস্বপ্নেও দেখাইনি, রক্ষা করে
এসেছি যুদ্ধের শেষ দুর্গের মতোন, সেই গোপন খবর এই বুড়ির কাছে এলো কি’করে? (ডাক্তার হাঁ হয়ে শুনতে থাকে) ...আমি নিজেকে
দুর্বল ভাবতে ঘেন্না করি। হাহ্, ভাবতে ভয় পাই। হ্যাঁ, এটাই আমার সবচেয়ে বড় ভয়—যদি
আমি কখনো এই গোপন কথাটা নিজের বুকের ভেতরে রক্ষা করতে ভুলে যাই? যদি কোনো
অসাবধানের ফাঁকে, মুখ ফস্কে কথায় কথায় বেরিয়ে আসে যে আমি আসলে ভীতু, যদি দেখিয়ে
ফেলি যে আমি আসলে দুর্বল? ওহ্, আমি যে বড়ই ভুলো, ডাক্তার! ভুল ক’রে যদি এই মস্ত
ভুলটা কখনো হয়ে যায়? দুর্বল মানুষ হতে আমি কোনোদিন চাইনি, লোকে আমায় দুর্বল ব’লে
চিনুক এও আমি হতে দিতে পারিনে! আমি দুর্বলদের চিরকাল ঘেন্না করে এসেছি। আমার বাবা
যখন নরওয়ের রাজাকে যুদ্ধে বধ করলেন, তখনি ক্যানো একেবারে ওই হারামজাদা ফর্টিনব্রাসকে
ঝাড়েবংশে উচ্ছেদ করলেন না? ক্যানো ওই সময় তার কিশোর পুত্র আর অপদার্থ ভাইটাকে জান
হাতে ক’রে পালাতে দিলেন? বাচ্চা ছেলের গলা কাটতে হাত কাঁপছিল বুঝি? দুর্বল
লাগছিলো?
ডা। (ভয়ে বিস্ময়ে ধরা ধরা গলায়)
বলো কি হে ছোকরা? এসব তো মহাকবি নাটকে লিখে যাননি! এসব তুমি জানলে কোত্থেকে?
হেম। (টেবিল থেকে গ্লাস
তুলে জল খেয়ে নেয়) আমি অনেকবার মনে মনে মহড়া দিয়েছি—আমি, হ্যামলেট, নিজের তরোয়াল
একটানে কোষমুক্ত করছি, আর নিখুঁত তুলির একটি আঁচড়ের মতো এক কোপে নরওয়ের কিশোর
রাজপুত্রের গলা ধড় থেকে আল্গা করে দিচ্ছি! ওহ্! আমায় দুর্বল বলবে এমন সুযোগ আর
কে পায়! দুর্বল মানুষ একটা ভূমিকম্পপ্রবণ জনপদের মতো, বুঝলেন ডাক্তার! গুরুগুরু
শব্দ কিংবা দোলাচল টের পেলেই পালিয়ে আসতে চায় বাড়ির ভেতর থেকে। ভাবুন একবার! সেই
বাড়ি, যা কিনা তাকে এতদিনের আশ্রয় দিয়েছে। সেই বাড়িটা, যা তাকে ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাতের
সময় কোল দিয়েছে, মাথায় ধরেছে ছাতা, আর নিজের গা-মাথা পেতে নিয়েছে বজ্রের আঘাত। সেই
বাড়িটা থেকে এ পালিয়ে আসতে চায়, যে বাড়ি ভিতরে-বাইরে সব অত্যাচার সহ্য করেছে
দুর্বল ছোট্ট মানুষটার হাত থেকে, পা থেকে, নখ-দাঁত-জিভ-চোখ-পায়ু-উপস্থ সবকিছু
থেকে! তার অর্থহীন খামখেয়ালি হাতুড়ির ঘা থেকে!
ডা। এই সলিলোকুই তো নাটকে
নেই! কিন্তু...এ যে সেই এক চরিত্র! হ্যাঁ, এক্কেবারে নির্ভুল নির্ভেজাল হ্যামলেট!
হেম। এই দুর্বল মানুষ, এই
দুর্বল ভুমিকম্পপ্রবণ জনপদ, সে শুয়ে আছে পাহাড়ের কোলে; কিংবা তার পায়ের কাছে। পাহাড়।
ধীরেসুস্থে, হাতে সময় নিয়ে উচ্চারণ করে দেখুন। থেমে থেমে ব’লে দেখুন না একবার। পা-হা-ড়।
ক্যামন অবর্ণনীয়, অতুলনীয়, অভ্রভেদী, স্থিতধী আত্মবিশ্বাস! কী অসম্ভব শক্তি আর
গর্ব ঝরে পড়ছে না শব্দটা থেকে? যে বা যারা এই শব্দ প্রথম জিভে এনেছিলো, ঠোঁটের
ফাঁক দিয়ে ধোঁয়ার রিং ছাড়বার কায়দায় গড়িয়ে দিয়েছিলো ইথারে, তাদের কুর্নিশ না ক’রে
উপায় নেই মশাই! পাহাড় মায়ের মতো। মায়ের মতোই সে নীচের তলার সব ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট
ছাড়িয়ে কোনো এক প্রশান্ত প্রদেশে মেঘের উপর তার মাথা উঁচিয়ে থাকে। আর সানুদেশ থেকে
বুক-গলা অব্দি বাকি গোটা শরীরটা সে বিলিয়ে দিচ্ছে অন্যদের জন্য। তার বুক থেকে সফেন
অমৃত নেমে আসে তাদের জন্য, যারা থাকে তার কোলেপিঠে কিংবা পায়ের কাছে। মাঝে মাঝে
পাহাড় নড়ে ওঠে। হাজার হোক্, তার বয়েস তো বেশি নয়। চলেফিরে বেড়ায়। অভিসারেও যায়
বোধহয়। তাও। তা-ও। কীভাবে দাঁড়িয়ে আছো তুমি, অ্যাতোদিন, এই সংসারে? অ্যাতো ধৈর্য
পেলে কোথা থেকে? মাঝে মাঝে ভাবি, যদি আমি মায়ের মতো হ’তে পারতুম!
ডা। তা তুমি কার মতো হয়েছ? কে
তুমি বলো দেখি।
হেম। আমি একটা পশু। জন্ম
থেকেই আমায় আমার বাপের গৃহে লালন-পালন করা হয়ে আসছে, তাই আমায় নিঃসন্দেহে গৃহপালিত
ব’লে ভাবতে পারেন। খাঁচায় থাকি, খুঁটে খুঁটে খাই। মাঝে মাঝে যখন খাঁচাটা আর সহ্য
হয় না, তখন ভেতর ভেতর খেপে উঠি। রাগ জমতে থাকে, গজরাতে থাকি। অস্থির হয়ে পায়চারি
করি ছোট্ট ঘরগুলোর চারদেয়ালের সীমানা বরাবর। ঠিক যেমন খাঁচার বাঘে করে।
ডা। (ভীষণ আমোদ পেয়েছে এমন
ভাবে) তা খাঁচার বাঘে তো ইচ্ছে করলেই খাঁচা থেকে বেরোতে পারেনা। কিন্তু তোমার তো
সে ঝামেলা নেই বাপু! চটি গলিয়ে দরজা ঠেলে বেরিয়ে পড়লেই হ’ল।
হেম। কিন্তু বেরোতে ইচ্ছে
করে না তো! বা বলতে পারেন, বাইরে বেরনোর ভাবনাটাই আপনাআপনি মাথায় আসে না।
ডা। হেঁহেঁ, ওইজন্যেই তো
তুমি বাঘ নও।
হেম। হি-হা-হা! কিন্তু আমার
আছে বাঘের মতো থাবা, আর আছে বড় বড় নখ।
ডা। (স্বগত) আর গায়ে আছে
জঙ্গুলে বোঁটকা গন্ধ।
হেম। কী বল্লেন?
ডা। না, মানে বলছিলাম—তোমার
তো লেজও নেই। তাই পেছন থেকে হঠাৎ কোনো আততায়ী হামলা করলে চাবকাতে পারবে না।
হেম। হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন!
দিনকাল যা হয়েছে, একখানা ক’রে লেজ থাকলে সবারই খুব সুবিধে হতো। পকেটমারের হাত লেজে ঠেকে যেতে পারতো, দু-হাতে দুটো বাজারের
থলে সামলেও দিব্যি বাচ্চাকে জড়িয়ে ধ’রে সিগন্যাল পেরোতে পারতো লোকে—কী বলেন?
ডা। আর পেছন দিয়ে যে
ইনকামটুকু হয় সেটাও আরেকটু রেখেঢেকে করা যেতো।
হেম। আরো হ’তে পারত—পেছনের
লোক লাইন ভেঙে সামনে আসতে চাইলে লেজ দিয়ে বাধা দিতে পারতেন।
ডা। (হেলান দিয়ে) মানে
এককথায় ‘লেজে খেলানো’ কথাটার বিশাল ব্যাপ্তি ঘটতো—ব্যাপক প্রয়োগ দেখা দিতো।
হেম। চরাচরব্যাপী ব্যাপ্ত
হয়ে যেতো একেবারে—লেজে লেজে রাস্তা আকীর্ণ –চাই কি একেবারেই জঙ্গলে পরিণত হতো
শহরের ব্যস্ত রাস্তাঘাট-ট্রেন-ট্রাম-বাস! মানুষে মানুষে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে
মানববন্ধনী তৈরি করতে হ’লে আর হাতব্যথা করতে হতো না!
ডা। (হাত কচলাতে কচলাতে,
হাসিমুখে) কিছু একটা দেখেশুনে উত্তেজিত হয়ে উঠলে লেজটাও সঙ্গে সঙ্গে খাড়া হয়ে
উঠতো! ওই যেমন কবি বলে গ্যাছেন—“লাঙ্গুল-খাড়া পাগল-পারা...”
হেম। হেঁহেঁ, সত্যি—যা
দিনকাল পড়েছে...
ডা। (খেঁকিয়ে) থামো! থামো
বলছি! অনেকক্ষণ সহ্য করছি। কিসব বাজে বকে মাথা ধরিয়ে দিলে! কাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে
এদিকে! নাসির! ওয়ে ব্যাটা নাসিরুদ্দিন! এটাকে ধরে বিদায় কর!
(এমন সময় ভেতর-ঘরের দরজা
দিয়ে একটি কুড়ি-বাইশ বছরের মেয়ের প্রবেশ। হেমকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। মেয়েটির দিকে
চোখ যেতেই হেম উঠে দাঁড়ায়।)
...এই অর্পি, নাসিরুদ্দিনকে
ডাক্ দেখি মা! বল্ এই আপদটাকে বিদেয় করতে হবে।
হেম। (চোখ বড় বড় ক’রে) কী নাম
বল্লেন? ওফি? ওফেলিয়া! ওফেলিয়া!
ডা। সর্বনাশ। এই ছোকরা, এটি
তোমার মাথার ভেতর চলতে থাকা ট্র্যাজেডির চরিত্র নয়, এ আমার মেয়ে অর্পিতা। এবার
যেখানে যেভাবে দাঁড়িয়ে আছো, ঠিক সেইভাবে থাকো—এক কদমও নড়বে না বলে দিচ্ছি, সাবধান!
আমি পুলিশ ডাকবো! (মোবাইল খুঁজতে থাকেন, না পেয়ে) কোথায় গ্যালো কোথায় ফোনটা আবার?
(ঘরের কোণে রাখা টেলিফোনের দিকে এগিয়ে যায়। ডায়াল করা শুরু করে) হ্যালো, শেক্সপীয়র
সরণি থানা?
হেম। (ভেজা চোখে ডাক্তারের
মেয়ের দিকে তাকিয়ে করুণ গলায়) ওফি...ওফেলিয়া...কতদিন বাদে দেখতে পেলুম তোমায়!
ক্যামন আছো? রাজপ্রাসাদে সবাই ক্যামন আছে?
(মেয়েটি কয়েক মুহুর্ত কি
করবে ভেবে না পেয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকে, তারপর খুব ভয় পেয়ে ‘বাবা গো’ ব’লে চিৎকার ছেড়ে
একছুটে ভেতর-ঘরে পালায়। পলাডাক্তার ফোন করতে করতে গোটা ব্যাপারটার ওপর
নজর রাখছিলেন, এবারে তাড়াতাড়ি ফোন সেরে ভেতর-ঘরে
যাবার দরজা আগলে দাঁড়ান)
ডা। ব্যাক অফ্! পিছে হটো!
বহুরূপী পাগলা সেজে ভদ্রলোকের মেয়ের উপর চড়াও হতে আসা হয়েছে! এখুনি পুলিশ এলো
ব’লে! পিটিয়ে পাগলামি সারাবে।
হেম। (দীর্ঘশ্বাস ফেলে)
To be, or not to be- that is the question:
Whether 'tis nobler in the mind to suffer
The slings and arrows of outrageous fortune
Or to take arms against a sea of troubles,
And by opposing end them. To die- to sleep-
No more; and by a sleep to say we end
The heartache, and the thousand natural shocks
That flesh is heir to. 'Tis a consummation
Devoutly to be wish'd. To die- to sleep.
To sleep- perchance to dream: ay, there's the rub.
ডা। হুহ্! ওসব নাটুকেপনা ক'রে তুমি আমায় ভোলাতে পারবে না, বাছাধন!
হেম। যখন বুড়ির প্রশ্নোত্তরের
পালা শেষ হ’ল, সে আমায় দেখালে একটি আয়না। খুব মিষ্টি ক’রে বল্লে, “হ্যামলেট, রাজার
ছেলে, যাও, ওই তোমার দরজা। ঘুরে এসো একবারটি। ফিরতে চাইলে আমার নাম ক’রে কোনো
এঁদোপুকুরে তোমার দুটো আশরফি ছুঁড়ে দিও। সঙ্গে সঙ্গে এই তাঁবুর বাইরে ফিরে আসতে পারবে।
যাও, যাও! দেরি কোরো না। ঘুরে এসো। দুনিয়াটা কির’ম জায়গা দেখেশুনে এসো।” আমি
জিগ্যেস করলুম, ওপারে কি আছে। সে বল্লে, “ভবিষ্যৎ!” পা বাড়ালুম, তারপরেই দেখি, এই
শহরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। সবার সাথে কথা বলতে পারছি তাদেরি মতো করে, তাদেরি
ভাষায়। অদ্ভুত সব গাড়ি-বাড়ি, অদ্ভুত অদ্ভুত যন্ত্র চারদিকে, মানুষের হাতে, কানে,
মাথায়, আকাশে, রাস্তায় সর্বত্র! এখানকার কোনো কিছুই যেন আমার জানতে বাকি নেই। কোথায়
কোন্ রাস্তা, কোন্ গলিটা কোন্খানে, কোথায় জামাকাপড়ের কি তেলেভাজার দোকান—আর সেই
দোকানকে এখানে কে কী নামে ডাকে, সমস্ত আমার মাথার মধ্যে কিলবিল করতে লাগলো।
কিন্তু, একটাও এঁদোপুকুর খুঁজে পেলুম না। একজন এই গলির মুখে বল্লে, কালুয়ার দোকানে
যাও। কালুয়া থাকে বারুইপুরে। সেখানে এঁদোপুকুর থাকলেও থাকতে পারে। তাকে খুঁজতে
খুঁজতে...
(ঘরে দুজন পুলিশ কনস্টেবলের
প্রবেশ। কোণের জানলা দিয়ে অর্পিতা মুখ বাড়িয়ে এঘরের কাণ্ডকারখানা দেখতে থাকে। পুলিশ আসতেই ডাক্তার হাঁ-হাঁ
ক’রে ওঠেন)
ডা। এই যে, এই সেই পাগলা।
ভোর থেকে ঘরে ঢুকে আবোল-তাবোল বকছে। কবে কোনকালে দু’কলি ইংরিজি নাটক পড়েছিল সেটাই
মাথায় ঘুরছে। (দুজন কনস্টেবল হেমকে দুদিক থেকে বগলদাবা করে ঘরের বাইরে নিয়ে যেতে
উদ্যত হয়) বলে কিনা হ্যামলেট! যাও বাবা হ্যামলেট, যেখান থেকে আসা হয়েছে সেই দেশে
ফিরে যাও। গিয়ে তোমার বাবার হত্যাকারী কাকার সাথে মায়ের বিয়েতে সানাই বাজাওগে!
হাহাহা!!
হেম। কী? কী বল্লেন? বাবার
হত্যাকারী? মায়ের সাথে বিয়ে?
ডা। সেকি! সবটা পড়া নেই
বোধহয়, সিলেবাসে শুধু সিলেকশন ছিলো বুঝি? হাহাহাহা! আপনারা ওকে জেলখানা কি
পাগলখানা যে চুলোতেই নিয়ে যান না কেন, একটা শেক্সপীয়র সঙ্গে দেবেন। অথবা, দেবেন
না। হ্যাঁ, না দেওয়াই ভালো। ওতে মাথার ব্যামোটা আরও চাগাড় দিয়ে উঠবে।
(হেম এক ঝটকায় নিজেকে মুক্ত
ক’রে ডাক্তারের গলার দিকে সশব্দে ধাবিত হয়)
(মঞ্চের সব আলো একসঙ্গে
নিভে যায়, টোটাল অন্ধকার।)
দৃশ্য ৪
(মঞ্চ ধীরে ধীরে আলোকিত হয়।
সে আলোয় দেখা যায় একটা প্রায় ফাঁকা ঘর, একখানা মাত্র গরাদ দেওয়া জানলা। এককোণে
একটা কুঁজো আর এনামেলের মগ। ঘরের মাঝখানে কড়া সাদা আলোর তলায় দর্শকদের দিকে মুখ
ক’রে একটা বেদির ওপর ব’সে আছে হেমচন্দ্র। মাথা দুহাতের মধ্যে রাখা, নিচের দিকে ঝোঁকানো। আস্তে আস্তে বাকি ঘরের আলো নিভে আসে,
শুধু হেমের উপর কড়া সাদা আলোটা লাইমলাইটের মতো জ্বলতে থাকে। হেম খুব ধীরে ধীরে মুখ
তুলে সামনের দিকে চায়।)
হেম। একটাও এঁদোপুকুর নেই।
অদ্ভুত জায়গা! হায়, আদরের দিন গিয়াছে ওফি, জলে ভেসে। জলও গ্যাছে ভেসে। আর তুমি
আমায় চিনতেও পারছ না। আমার কী হবে! আমার খুব ভয় করছে, ভয় করছে! আমি কে? ওফি আমায়
চিনতেই পারলে না? ওহ্, আমি তো এখন আমি নই। আমি উন্মাদ। (যেন খেপে গ্যাছে, এমন
ক’রে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকে) আমি উন্মাদ। আমা হইতে হইতে সদাসর্বদা সদাসর্বদা
কয়েক কয়েক হস্ত হস্ত দূরে দূরে থাকুন থাকুন। নহিলে...আমি নখদন্ত খিঁচাইয়া তেড়ে
আসিতে পারি—আপনার নধর অঙ্গে কামড়া বসাইয়া জলাতঙ্ক বাধাইয়া দিতে পারি। শিশুগণের আমা
হইতে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন অবশ্য পালনীয়। অমাবস্যার রাত্রে যখন কৃষ্ণবর্ণ
মার্জারনী অভিসারে বাহির হইয়া আপন সঙ্গীর উদ্দেশ্যে কামাতুর আর্তনাদ করিতে থাকে,
তখন আমার পাগলামি ভীষণরকম বাড়িয়া উঠে। আমি তখন বিচিত্র ভূষণ পরিধান করিয়া দুর্বার
নৃত্য করিতে থাকি। সে নৃত্যের সহিত সঙ্গত করিতে দুন্দুভিবাদ্যযোগে ভীষণ সঙ্গীতও
আমা-দ্বারাই পরিবেশিত হইয়া থাকে। সঙ্গীতশাস্ত্রে মদীয় কুশলতার কথা অনেকেই
যৎকিঞ্চিত অবগত আছেন নিশ্চয়ই।...
যেহেতু আমি পুংজাতীয়, তাই
মদীয় উন্মত্ত স্বভাব নারীগণের পক্ষে বিশেষরকমে দুঃসহনীয়। তাই জনস্বার্থে রমণীদিগকে
এই পরামর্শ দেওয়া যাইতেছে যে, তাঁহারা যেন আমা হইতে আপনাপন প্রাণধন বাঁচাইয়া
চলিবার নিমিত্ত বিশেষ যত্ন করেন। আমার সহিত কোনোরূপ আলাপ তাঁহাদের সুবিবেচনার
পরিচায়ক হইবে না। যদি কোনো বিশেষ কারণে ইহা পরিহার করা একান্তই অসম্ভব হয়, তাহা
হইলে বর্ম, সশস্ত্র দেহরক্ষী, অথবা নিদেনপক্ষে চিলি-স্প্রে সঙ্গে রাখা
অবশ্যকর্তব্য। একথা ওফেলিয়াজাতীয়া নরম-প্রকৃতির মেয়েমানুষ হইতে লেডী ম্যাকবেথের
ন্যায় দুর্ধর্ষ রমণী—সকলের জন্যই প্রযোজ্য হইবে।
(একজন কনস্টেবলের প্রবেশ,
বাঁদিক দিয়ে)
কনস্টেবল। এই পাগলা, ওঠ্।
বড়সাহেব তোকে একটা এঁদোপুকুরের ধারে ছেড়ে আসতে হুকুম দিয়েছেন।
(হেম তড়াক্ ক’রে লাফিয়ে
ওঠে।)
(পর্দা)
['ডাকবাক্স' পত্রিকায় ২০১৫-র সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত]
No comments:
Post a Comment